করোনা কালের এই রমজান মহান আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ- ডাঃএম.জি মোস্তফা


প্রকাশের সময় : এপ্রিল ২৭, ২০২০, ১০:২৮ AM
করোনা কালের এই রমজান মহান আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ- ডাঃএম.জি মোস্তফা

করোনার নৃশংস তান্ডবে পৃথিবী যখন মৃত্যুপুরী, সভ্যতার চাকা যখন ঘুরছে সময়ের উল্টো রথে, মানবজাতি যখন দিশেহারা, পথহারা; তামাম দুনিয়ার মানুষ যখন করোনার নির্মম কারাগারে বন্দী হয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনছে, তখন রহমত, বরকত, মাগফেরাত, নাজাত ও মুক্তির সুসংবাদ নিয়ে মানবজাতির মাঝে উপস্হিত হয়েছে রমযানুল মোবারক। মানবজাতির ক্রান্তিকালে এই রমজানের গুরুত্ব, তাৎপর্য, মুল্য বহুগুন বেশী। দিশেহারা মানবজাতির কাছে রমজান এসেছে আলোক পথের দিশারী হয়ে,শান্তির দূত হয়ে, মুক্তির ঝান্ডা নিয়ে। করোনা কালের এই রমজান মহান আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ,অশেষ নিয়ামত।অস্তিত্বের চরম সংকট কালে আগত রমজান মানবজাতিকে,মানব সভ্যতাকে টিকিয়ে রাখার এক মোক্ষম সময়।পাপের সাগরে নিমজ্জিত,সীমালঙগন কারী,পথভ্রষ্ট মানব জাতি যদি তওবা করে,ক্ষমা প্রার্থনা করে, আত্নোপলব্ধি, আত্ননোশোচনার মাধ্যমে কোরআন,হাদীসের নির্দেশিত পথে ফিরে এসে আল্লাহর করুণা লাভ করতে সমর্থ হয়,কেবল তখনি আল্লাহর অতিক্ষুদ্র সৃষ্টি করোনার হাত থেকে বাঁচা সম্ভব।কারন আকাশ থেকে পাতাল পর্যন্ত এমন কোন ঘটনা নেই যা সম্পর্কে আল্লাহ অবগত নন, এমন কোন প্রানী/জীব/জড় নেই যা আল্লাহর নির্দেশ ব্যতীত পৃথিবীতে আসতে পারে,আর এমন কোন মুত্যু নেই যা আল্লাহর নির্দেশ ব্যতীত হয় অর্থাৎ জন্ম,মৃত্যু করোনা ভাইরাস সবই আল্লাহর হুকুমের গোলাম,এদের কারো কোন কিছুর করার কোন ক্ষমতা নেই একচুল নড়ার, এদিক ওদিক হবার। কাজেই করোনাকে ভয় পেয়ে লাভ নেই, রক্ষাও পাওয়া যাবে না। আমাদের ভয় পেতে হবে কেবল জগতের সকল ক্ষমতার মালিক,সর্বশক্তিমান আল্লাহকে;করোনার সকল কন্ট্রোল যার হাতে,করোনা যার নির্দেশে কাজ করে,যার প্রদত্ত ক্ষমতায় করোনা শক্তিশালী হয়ে মানবজাতিকে বিপন্ন করে তুলেছে।
সেই মহান রাব্বুলকে রাজী খুশি করে মাফ পাবার,মুক্তি পাবার শ্রেষ্ঠ সময়,সুবর্ন সুযোগ এই মাহে রমজান। রমজান মাসেই জান্নাতের সবক’টি দরজা খুলে দেয়া হয়, জাহান্নামের সবক’টি দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়,শয়তানকে শৃঙ্খলিত করে (লক আপে) রাখা হয়।আল্লাহকে রাজী খুশি করার জন্য যারা রোজা রাখেন তাদের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেন।রমজানের চেয়ে পাপ মুক্তির, মাফ মুক্তির আর কোন উত্তম সময় নেই মানবজাতির সামনে।কাজই রমজানে সব তওবা করে,সব ভুল পথ পরিহারকরে,আত্নসংযম,আত্নত্যাগের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালাকে রাজী খুশির মাধ্যমে আল্লাহর দয়া,করুণা অর্জনের মাধ্যমে করোনার হাত থেকে মুক্তির শ্রেষ্ঠ পথটিই খুঁজে বের করতে হবে অভিশপ্ত মানবজাতিকে।
সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার থেকে বিরত থাকার নাম রোজা নয়,একে উপবাস বলে।আল্লাহর কাছে এই উপবাসের কোন মুল্য নেই।আল্লাহর কাছে মুল্যবান কেবল উপবাস থাকার অর্থের,তাৎপর্যের।রোজা বা রমজান অর্থই হলো জ্বালিয়ে দেয়া,পুড়িয়ে দেয়া,ভষ্ম করে দেয়া,ছাই করে দেয়া।অর্থাৎ রমজানের অর্থ ও উদ্দেশ্য হলো মানব মনের পশুবৃত্তিকে,ষড় রিপুকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে নিজেকে শুদ্ধ মানুষে পরিনত করা।কাজেই রোজা রাখার পরেও যদি কোন মানুষ লোভ লালসা করে,মানুষের অনিষ্ট করে,পরচর্চা করে,গীবত করে,দুর্নীতি করে,মানুষকে শোষন করে,অধিকার লঙগন করে আল্লাহর কাছে তার রোজার কোন মুল্যই নেই,এর বিনিময়ে সে কোন পুণ্য অর্জন করতে পারবেনা,কোন পাপমুক্তিও পাবেনা। ত্রই রোজা রাখা আর না রাখা একই কথা।রমজানে পশুবৃত্তি থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে পুণ্যের খাতা শূণ্যই থাকবে,বৃথা যাবে রমজানের উপবাস।
প্রতিবারই রমজান আসে মানুষের অন্তরকে পরিশুদ্ধ করে, আধ্যাত্নিক সজীবতা ও আত্নিক দৃঢ়তা প্রদান করে, বহুবিধ মারাত্নক ব্যধির মোকাবেলা করে, সুস্হ সমাজ, সুস্হ দেহ উপহার দিয়ে শান্তির পুথিবী বিনির্মান করতে। অথচ রমজান আসলে অনেক মানুষই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে,বিভিন্ন অজুহাত খুঁজে রোজা না রাখার। অনিবার্য কারন ব্যতীত রোজা রাখাই উত্তম।রোজা স্বাস্হ্যের কোন ক্ষতিই করেনা বরং আগের চেয়ে সুস্হতা ও আত্নিক দৃঢ়তা অর্জন হয়।
রোজা মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, ক্যান্সার প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় ৩-৫ গুন।রোজায় মানুষের আয়ু ৫০ বছর পর্যন্ত বাড়তে পারে।
আমাদের লিভার, পাকস্হলি কিডনী হার্ট টানা ১১ মাস বিরতীহীন কাজ করতে করতে দুর্বল হয়ে পড়ে, রমজানেই কেবল বিশ্রামের সুযোগ পায়।এই সুযোগে দুর্বল অঙ্গ প্রত্যঙ্গ গুলো সতেজ সবল, কর্মক্ষম হয়ে ওঠে।
অনেকেই বলে থাকেন রোজায় গ্যাস্ট্রিক বাড়ে,তবে গবেষনায় প্রমানিত গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা দুর করার জন্য রমজানই উত্তম সময়।
হার্টের রোগীদের জন্য রেজা আশীর্বাদ স্বরূপ। রোজায় প্রেশার কমে, কোলেস্টরল কমে, স্হুলতা কমে, স্ট্রোকের ঝুঁকি কমে, রক্তনালীর ব্লকের ঝুঁকি কমে।
ডায়াবেটিস কন্ট্রোলেরও উপযুক্ত সময় রোজা। বেশী বেশী ইবাদতের ফলে মেরুদন্ড ও অন্যান্য জয়েন্টের ব্যথা মাংশপেশীর বাত ব্যথা কমে। স্নায়ুরোগ, দন্ত রোগ প্রতিরোধে, মানসিক স্বাস্হ্যের উন্নয়নে, যৌনব্যধি মোকাবিলায় রোজার ভুমিকা অনস্বীকার্য।
পেপটিক আলসারের রোগী, ডায়াবেটিস রেোগী, অ্যাজমার রোগী, কিডনীর রোগী, হার্টের রোগী,গর্ভবতী ও দুগ্ধ প্রদানকারী মা নিয়ম কানুন অনুসরন করে-সর্বোপরি চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহন করে যে কেউ রোজা রাখতে পারেন, অনিবার্য কারনে পরেও রাখতে পারেন ইসলামী শরীয়াহ অনুযায়ী।
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন,”ছুমু তাছিহহু”অর্থাৎ রোজা রাখবে, সুস্হ্য থাকবে। এই বানী চিকিৎসা বিজ্ঞানের মহিমায় উদ্ভাসিত হয়েছে। যুগে যুগে তাই চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা খুঁজে ফিরেছেন রোজার রোগ নিরাময় ক্ষমতা। অবশেষে বিজ্ঞানীরা বিস্মিত হয়েছেন ১৪শত বছর আগের সেই বানীর বৈজ্ঞানিক সত্যতা দেখে। এতে প্রমানিত হয়েছেন হযরত মোহাম্মাদ (সাঃ) কতো বড় বৈজ্ঞানিক ছিলেন।প্রমানিত হয়েছে কোরআন ও ইসলাম চিরন্তন, চির সত্য, চির আধুনিক,বৈজ্ঞানিক সত্য, সর্বযুগে সর্বকালে সকল মানুষের জন্যই কল্যাণকর।
বিশ্ববিখ্যাত চিকিৎসক ইবনে সিনা বহু শতাব্দী আগেই রোগীর সময় প্রথমেই রোগীকে তিন সপ্তাহের উপবাস বা রোজা রাখতে বলতেন।
হিন্দু ধর্মের গুরু মহাত্না গান্ধী বলেছেন,”যদি তোমরা শরীরকে সতেজ ও সচল রাখতে চাও,তবে শরীরকে ন্যূনতম আহার দাও এবং পূর্ণ দিবস রোজা রাখো।রোজা অতি উত্তম এক নিয়ম।মনের তাগিদে আমিও এ ধরনের নিয়ম পালন করি,যদিও আমি এক খাঁটি ব্রাহ্মণ।
সোভিয়েত রাশিয়ার প্রখ্যাত চিকিৎসা বিজ্ঞানী বলেছেন,”সারা বছর মানব শরীরে যে টক্সিন বা জৈব বিষ জমে,তা শরীর থেকে বের করার সবচেয়ে ভালো উপায় রোজা।
রোজার মানুষের স্মরনশক্তি বাড়ায়, যুক্তি ক্ষমতা, বুদ্ধি করে, প্রীতি ভালোবাসা সহানুভূতির সৃষ্টি করে, দৃষ্টিভঙ্গী উদার করে, ঘ্রান শক্তি, শ্রবন শক্তি বৃদ্ধি করে-অতিন্দ্রীয় ও আধ্যাত্নিক শক্তির উম্মেষ ঘটায়।এক কথায় বোজার মহিমা কিছুতেই বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না। রমজান মাস কেন সকল মাসের সেরা,কেনই বা রমজানের এতো গুরুত্ব? কারণ একটাই এই মাসেই নাযিল হয়েছে মহাগ্রন্হ আল কোরআন-যা মানব জাতির মুক্তির দিশারী, পুর্নাঙ্গ জীবন বিধান, শ্রেষ্ঠ আইনগ্রন্হ। কাজেই রমজানে রোজার পাশাপাশি কোরআন তেলাআতের গুরুত্ব অপরিসীম। কিয়ামতের দিন রোজা এবং কোরআন বান্দাহ’র জন্য জন্য সুপারিশ করবে এবং রাব্বুল আলামিন সেই সুপারিশ মঞ্জুর করবেন। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, রমজান পাবার পরেও যে ব্যক্তি তার গুনাহ মাফ করাতে পারলো না, তার মতো হতভাগা ব্যক্তি জগতে আর কেউ নেই।
প্রতিদিন মৃত্যুর মিছিল বাড়ছেই। কার কখন ডাক আসবে সেই মিছিলে যোগদানের তা কেউ জানে না। করোনা কালের এই রমজানকে ধরে নিতে হবে হয়তো বা এটাই জীবনের শেষ রমজান, গুনাহ মুক্তির শেষ সুযোগ। তাই আসুন আমরা সবাই জীবনের শেষ সুযোগটিকে সর্বোত্তম ভাবে কাজে লাগিয়ে জান্নাতের পথকে প্রশস্ততর করি, একজন মুমিন হিসেবে মরার প্রস্তুতি গ্রহন করি, সিয়ামের সযংমের মাধ্যমে, আত্নশুদ্ধির মাধ্যমে, নফসের পশুবৃত্তি দমনের মাধ্যমে মহান রাব্বুল আলামিনকে রাজী খুশি করে আল্লাহর দরবারে করোনা থেকে মুক্তি চাই।আল্লাহ মাহে রমজানের উছিলায় মানবজাতিকে করোনার হাত থেকে মুক্তি দান করুন, পথভ্রান্ত মানবজাতিকে ক্ষমা করে সঠিক পথের সন্ধান দিন,আত্নোপলব্ধির মাধ্যমে মানব জাতিকে নিয়ে আসুক শান্তির পতাকা তলে।আমীন।
(আমার প্রানপ্রিয় বন্ধুরা, আল্লাহর অপার রহমতে, আপনাদের অশেষ দোয়ার বরকতে, আলহামদুলিল্লাহ আমি সুস্হই আছি। কষ্ট হলেও কলামটির কলেবর বড় করেছি, যদি এর মাধ্যমে কারো কোন কল্যান হয়। আল্লাহর সবার মঙ্গল করুন।)

https://www.bkash.com/