অসম প্রেম- বনানী বিশ্বাস


প্রকাশের সময় : জানুয়ারী ১২, ২০১৯, ৬:২৪ PM
অসম প্রেম- বনানী বিশ্বাস

হাসান বিমানে বসে বসে দেখছে সাজানো গোছানো হিথরো বিমান বন্দরকে। বৃটিশরা সত্যিই সভ্য জাতি।এত পরিপাটি এবং গোছানো বিমানবন্দর সে কোথাও দেখেনি।মূহুর্মূহু বিমান ওঠছে নামছে কোথাও কোন অসংলগ্নতা নেই।বোয়িং বিমানের পেটের ভিতরে এত জায়গা।লন্ডন ছেড়ে যেতে তার মনটা খুব কাঁদছে এবার।দীর্ঘদিন পড়ালেখা শেষ করে এবার সে পারমানেন্টলি দেশে থাকবে।আর বিদেশের মাটিতে নয়, এবার নিজের দেশেই সে কিছু একটা করবে।হঠাত প্লেনটা দুলে উঠল।সে সচকিত হল, এই বুঝি প্লেন ছাড়ল।যাত্রীরা উঠে যে যার জায়গায় বসছে।দরজার দিকে তার চোখ আটকে গেল। মনে হল ভীষণ একটা চেনা মুখ।না এবার আর প্লেন দুলে উঠলনা।হাসান যেন চোখে সরষে ফুল দেখল।তার শ্বাস প্রশ্বাস দ্রুত বেড়ে গেল,ধমনীতে রক্ত চলাচল বেড়ে গেল বহুগুনে, অলিন্দের প্রকোষ্ঠে ধপাস ধপাস শব্দ শুনতে পেল।সে ভুল দেখছেনাতো।” বনলতা”!হ্যা বনলতাইতো। এওকি সম্ভব?এই দূর বিদেশ বিভুঁইয়ে, হয়ত চোখের ভ্রম। সে ভালো করে দেখল।না ভুল দেখেনি।বনলতার সাথে দুটো বাচ্ছা।কি করবে বা কি করা উচিত হাসান ভেবে পাচ্ছেনা।সে উঠে দাড়াল।বনলতার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করল।

সাগরদাড়ির কোল ঘেসে বয়ে যাওয়া উজলপুর গ্রাম।সে গ্রামের সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান হাসান।হাসানের বাবা একজন আর্মি অফিসার।আট ভাইবোন তারা।দারুন হৈ চৈর ভিতরে ওরা বেড়ে ওঠেছে।বাবা শহরে চাকুরি করলেও ওরা গ্রামেই থাকে।গ্রামের জল হাওয়ায় বেড়ে উঠেছে হাসানের পরিবার।হাসান সবে ক্লাস নাইনে উঠেছে।পাশের গ্রামের নয়নপুর উচ্চ বিদ্যালয় বিখ্যাত স্কুল।ঐ স্কুলে পড়ে তারই খালাতবোন ছবি।একদিন ছবি ওদের বাড়িতে বেড়াতে আসে।বোনের কাছে গল্প শোনে নয়নপুর স্কুলের।হাসান খুব অবাক হয় যখন শোনে ছবির ক্লাশে ফার্স্ট হয় একটি মেয়ে।সে খুবই অবাক হয়।তবে কৌতুহলি ও হয় বোনের ক্লাশের ফার্স্টগার্লকে দেখার।সে তার মায়ের কাছে দাবি জানায় নয়নপুর উচ্চবিদ্যালয়ে পড়ার।খুব ভালো স্কুল।তাই মাও রাজী হয় তাকে পড়াতে।হাসান নয়নপুর স্কুলে ভর্তি হয়ে যায়।

নতুন জায়গা নতুন পরিবেশ। খাপ খাইয়ে নিতে বেশ সময় লাগে।নতুন বন্ধুদের সাথে সখ্যতা তৈরীতে অনেক মনোযোগী হতে হয়।সেই সাথে টিনেজ বয়সে কত রঙিন স্বপ্ন তখন দুচোখ ভরে। হাসান অনেকটাই আলাদা প্রকৃতির। সে একটু চুপচাপ টাইপের। স্কুলের বন্ধুদের সাথে অকারন হৈচৈ এ সে সমানতালে মেতে ওঠেনা,সে পারেনা সবার মত গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিতে। এ গ্রামের অধিকাংশই দরিদ্র পরিবারের সন্তান, সেখানে সে স্বচ্ছল ও উচ্চশিক্ষিত পরিবারের সন্তান।গ্রামের সাধারন সন্তানদের থেকে সে একটু আলাদা। চাল চলনে কিছুটা কেতাদুরস্ত।প্রায় ছয় মাস হয়েছে সেএ স্কুলে এসেছে। হাসানের খুব ইচ্ছে হয় ছবির ক্লাশের ফার্স্ট গার্ল যার কথা সে ইতোপূর্বে জেনেছে তার সাথে পরিচিত হতে।কিন্তু গ্রাম্য পরিবেশে সহজে কথা বলার সুযোগ সে সময়ে কমই ছিল। কিন্তু হাসানের বুকের ভিতর উথাল পাতাল করে ছবির বন্ধুর সাথে কথা বলার।কি যে এক অদম্য ইচ্ছা তার বুকের ভিতর সব সময় দাপিয়ে বেড়ায় কিন্তু সাহস পায়না ওর সাথে কথা বলার। হাসান ও খুব অবাক হয় সম্পূর্ণ না দেখেই সে একটি মেয়েকে অন্ধভাবে ভালোবাসে। কি করে হল, এটা সে ভেবে পায়না।সন্ধ্যার খোলা আকাশে নিচে দাড়িয়ে ঝিরিঝিরি বাতাসে তার খুব ইচ্ছে করে ছবির বন্ধুর সাথে কথা বলতে।

বছর শেষ হয়ে নতুন বছরে নতুন ক্লাশে উঠেছে।ফেব্রুয়ারী মাসে স্কুলে সরস্বতী পূজো হবে।সাজ সাজ রব। সাজছে স্কুল সাজছে চারিপাশ। হাসান ছবিকে চেপে ধরল তার বন্ধুর সাথে কথা বলিয়ে দিতে। ছবি রাজী হল।আজ থেকে বিশ বছর আগে স্কুলে কোন ছেলেমেয়ে একান্তে কথা বলবে সেটি একটি স্বাভাবিক বিষয় ছিলনা। সরস্বতী পূজো শেষে ছবি তার বান্ধবীকে নিয়ে একটি ক্লাশরুমে যাবে।হাসান সেখানে আগেই উপস্থিত থাকবে।পূজো যথারীতি শেষ হল। হাসানের বুক দুরু দুরু করছে। কি বলবে সে, সেতা নিজেই জানেনা। তারও খুব ভয় করছে।কিন্তু তার আজ কথা বলতেই হবে। হাসান যে ওকে ভালোবাসে। কোনদিন না দেখেই সে তাকে ভালোবেসে ফেলেছে।হাসান ভাবছে সে সরাসরিই বলবে আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি। ক্লাশে দোতলার একটি রুমে বসে বসে সে ভাবছিল। হঠাত করেই দরজায় শব্দ শুনেই সে সম্বিত ফিরে তাকাল।সে কি দেখছে এটা? স্বয়ং দেবি সরস্বতী? হাসান অবাক হয়ে দেখছে। তার ভালোবাসার মানুষটি তার সামনে। লাল পাড়ের একটি সাদা শাড়ি পড়া।কি অপূর্ব যে লাগছে তাকে।হাসান নির্বাক!কি বলবে? আস্তে আস্তে সে ওর কাছে এসে বলল,”বনলতা”তুমি এত সুন্দর কেন?না আর কিছুই বলতে পারলনা। তার মুখ থেকে কোন শব্দই বের হলনা।সে শুধু বোকার মত তাকিয়ে দেখছে বনলতাকে। তার কল্পনার, স্বপ্নের মানুষটি এত সুন্দর।বনলতা কোন কথাই বললনা। সে শুধু ছবিকে বলল চল পূজোতে আরও অনেক কাজ বাকি আছে। হাসান চেয়ে চেয়ে বনলতার চলে যাওয়া দেখল। গোঁধুলি লগনের আটপৌড়ে সন্ধ্যায় সে জানেনা ভাগ্যদেবতা তার জন্য কি লিখে রেখেছে। সন্ধ্যার প্রদোষকালে বুকের ভিতর হুহু করে উঠেছে, সে অনুভূতি কি সে শুধু বিধাতাই জানে।

ক্লাশে সহযোগিতার নামে হাসান অনেক সময়ই বনলতাকে অংক বুঝিয়ে দেয়।সুযোগে বইয়ের পাতার মধ্যে ঢুকিয়ে দেয় ছোট্ট চিরকুট। সেই চিরকুটে থাকে ভালোবাসার মৌগন্ধ।বনলতা সযত্নে রেখেদেয় সেগুলো। সে হাসানের এসব চিঠির জবাব দেয়না।ভয় পায়। বনলতা বোঝে এ ভালোবাসা ভয়ানক।তবু ও হাসানকে না বলতে পারেনা। এসএস সি পরীক্ষা দিয়ে হাসান ঢাকা কলেজে ভর্তি হয়। খুব কষ্ট হয় হাসানের।যোগাযোগ করার কোন উপায় নেই।কেননা বনলতা চায়না তাদের যোগাযোগ থাকুক।তাদের মাঝে আর যোগাযোগ হয়না।এইসএসসি পাশ করে বনলতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হয়। বনলতা তখন দ্বিতীয়বর্ষের ছাত্রী।একদিন সন্ধ্যায় ছবি তার হলে এসে তাকে একটা চিঠি দেয়।বলে হাসান ভাই চিঠিটা তোকে দিতে বলেছে। পড়ে জবাব দেয়ার মনে হলে জবাব দিস।বনলতার হাত পা যেন ঠান্ডা হয়ে গেছে।তার জীবনের প্রথম প্রেম প্রথম ভালোবাসা!বনলতা চিঠিটা খুলল।সাদা কাগজে সেই পরিচিত হাতের লেখা যেখানে রয়েছে নিস্পাপ ভালোবাসার গন্ধ।দীর্ঘ চিঠি। বনলতা চিঠিটা পড়ে স্তব্দ হয়ে গেছে। তার দুচোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু তার চারিপাশ অন্ধকার হয়ে আসছে। কি কারা উচিত বুঝতে পারেনা সে। কিন্তু হাসানের জন্য তার প্রচন্ড কষ্ট হতে লাগল।

চিঠিতে ছিল “আমি একজন মৃত্যুপথযাত্রী, তোমাকে দেখতে ভীষণ ইচ্ছে করছে।খুব ইচ্ছে ছিল তোমার হাত ধরে খোলা আকাশের নিচে একসাথে হাঁটি। আমার ইচ্ছেগুলো আমারই থাকুক।যদি একটিবার বল তোমাকে দেখতে চাই। একটিবার তোমার হাত ছুঁয়ে দেখব।শুধু একটিবার দেখা করার অনুমতি দাও। আমার লিভার সিরোসিস হয়েছে।গত একবছর হল ঢাকা চলে এসেছি।এখানে চিকিৎসা চলছে।”বনলতা কি করবে বুঝতে পারছেনা।এই অসম প্রেমকে পরিনতি দেয়ার সাহস তার নেই। কিন্তু সেও হাসানকে ভালোবাসে। তার খুব ইচ্ছে হয় ছুটে গিয়ে হাসানের পাশে দাড়ায়।তাকে বলে তোমার কিচ্ছু হয়নি। তুমি একদম ভয় পেয়োনা।কিন্তু তার যে অত সাহস নেই। বনলতা ছবির সাথে কথা বলল।ছবিও বলল তুই একটিবার অন্তত দেখা কর।ছবি তাকে হাসান ভাইয়ের কাছে নিয়ে গেল।বনলতা ডুকরে কেঁদে উঠল।হাসানকে চেনাই যায়না।তার শরীর একদম ভেঙে গেছে।হাসান তাকে কাছে ডাকল। বনলতার একটি হাত ধরে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর ধীরে হাতটা সরিয়ে দিল। বলল আমার খুব ভালো লাগছে। তুমি আমার জন্য দোয়া কর।সেই দেখা হল। আর যোগাযোগ করেনি কেউ।

আজ বিশ বছর পরে হিথরো বিমান বন্দরে হাসানের সাথে বনলতার দেখা।বনলতা ও নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেনা।বিমানের ভেতরে ঢুকে বনলতা দেখল একজন লোক তার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছে। কাছে যেতে বনলতা বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে গেল। তার সাথে তার স্বামী সন্তান। সে তার স্বামী সন্তানের সাথে তার পরিচয় করিয়ে দিল। বনলতা তার স্বামীর চাকুরি সুবাদে লন্ডনে সেটেল হয়েছে। তারা উভয়ে দেশে ফিরছে।অনেক চিকিতসার পর হাসান কিছুটা সুস্থ হয়েছে তবে সে এখনও সম্পূর্ন সুস্থ নয়। তারপর পড়াশোনার জন্য সে লন্ডনে চলে এসেছে। ঢাকা বিমানবন্দরে নেমে হাসান বনলতাকে একটি কার্ড ধরিয়ে দিল।বনলতা তার চলে যাাওয়া দেখল। কি এক অমোঘ নিয়মে তার সাথে হাসানের যোগাযোগ হয়ে যায় বার বার। বনলতা ভাবে ওর সাথে দেখা না হওয়াাই ভালো। কেন এই দেখাদেখি আর কতইবা চলবে। বিধাতা কেন বার বার তাদেরকে এক জায়গায় নিয়ে আসে। যে পথ মিলবার নয় একসাথে, সে পথ দুদিকে সরল পথেই চলুক।

https://www.bkash.com/