রবিবার, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৭:১৯ পূর্বাহ্ন
ফুলবাড়িয়া নিউজ 24 ডটকম : সম্প্রতি বাংলাদেশে মুক্তচিন্তকদের হত্যা, পাকিস্তানের ধর্মীয় সহিংসতা, ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে বিতর্কিত লেখিকা তসলিমা নাসরিন বলেছেন, জিহাদীরা জামায়াতের সহায়তা পায়। ভারতের দ্য ইকনমিস্ট টাইমস এর প্রতিবেদক আর্তি টিকো সিং’কে দেয়া তসলিমার সাক্ষাৎকারটি আমাদের সময়.কম এর পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল:-
আর্তি টিকো সিং: ২০১৩ সাল থেকে বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষ লেখক, ব্লগার, অধ্যাপক, সংখ্যালঘু ধর্মীয় নেতা ও বিদেশিদের টার্গেট করে হত্যা করা হচ্ছে। কেন তাদের বাংলাদেশেই টার্গেট করা হচ্ছে? হত্যা করছে?
তসলিমা নাসরিন: জিহাদীরা নীরবে এই কাজ করছে। কারণ গণতন্ত্র ও বহুত্ববাদ তাদের কাছে অভিশাপ। তারা ধর্মতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশকে দারুল ইসলাম বা ইসলামের মাটি বানাতে চায়। নারীঅধিকার ও বাকস্বাধীনতা রুদ্ধ করে শরীয়াহ আইন কায়েম করতে চায়। তারা এমন একটি রাষ্ট্র সৃষ্টি করতে চায় যেখানে চিন্তার স্বাধীনতা নেই।
বাংলাদেশে ১৪৮টি জিহাদী প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে। এই জিহাদীরা জামায়াতে ইসলামের সহায়তা পায়। আনসারুল্লাহ বাংলা টিমসহ ১৩টি সন্ত্রাসী সংগঠন রয়েছে। ২৩১ মৌলবাদী সংস্থা রয়েছে। বিগত ৪০ বছরে ৪০ হাজার কোটি টাকা বাংলাদেশের জিহাদীদের প্রশিক্ষনে ব্যয় করা হয়েছে। মোট আয়ের ২০ শতাংশ হয় ইসলামি মৌলবাদী অর্থনীতি থেকে।
আর্তি টিকো সিং: ছয় বছর আগে বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা পুনঃস্থাপন করা হয়, যা খুব ভাল। বিগত কয়েক বছর ধরে ধর্মনিরপেক্ষতার বিরুদ্ধে কি ঘটছে?
১৯৭১ সালে যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতে ইসলামের বিচার ও দোষী সাব্যস্ত করাতেই কি বাংলাদেশে এই সহিংসতা?
তসলিমা নাসরিন: যদি তাই হয়, ইসলামপন্থীরা বিচারক ও ক্ষমতাসীনদের উপর হামলা করতে পারে। তবে তারা নাস্তিক ব্লগারদের, ইসলামের সমালোচনাকারীদের, বুদ্ধিজীবী এবং প্রগতিশীল মুসলিমদের হত্যা করছে। ইসলামপন্থিরা যে কাউকে হত্যা করতে পারে, অব্যাহতিও দিতে পারে। কারণ গত কয়েক বছর ধরে ব্লগারদের সমালোচনা করে সরকার ইসলামপন্থিদের উৎসাহিত করছে। এই চিন্তা বাংলাদেশকে মধ্যযুগে নিয়ে যাচ্ছে।
আর্তি টিকো সিং: বাংলাদেশের ধর্মীয় চরমপন্থীদের ব্যাপ্তি কতদূর? আইএস কি তাদের সমর্থন পাচ্ছে? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিভাবে ধর্মীয় মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে লড়ছে?
তসলিমা নাসরিন: দেশের সকল সন্ত্রাসী ও মৌলবাদীরা আইএসকে সমর্থন করে। অনেকে ইরাক ও সিরিয়ায় আইএসের প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার কারণে শেখ হাসিনা তা অস্বীকার করে আসছে। রাজনৈতিক কারণে সহজেই তা অস্বীকার করা যায়। নাস্তিক ও ব্লগারদের উপর হামলা ও হত্যা তার দাবি অনুযায়ী স্বাভাবিক বিষয় । ইসলামপন্থীরা তাকে একবার গ্রেনেড হামলা করেছিল। রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার কারণে তিনি সেটি ভুলে গিয়েছেন। প্রচারে তিনি নিজেকে একজন ধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তি হিসেবে প্রচার করেন। আবার তিনি নিজেই বলেন, তিনি গভীরভাবে ধর্মানুরাগী। বাংলাদেশে রাজনৈতিক নেতৃত্ব কতটা ধর্মানুরাগী তার প্রতিযোগীতা চলছে। রাজনৈতিকরা ধর্মকে ব্যবহার করে ভোট আদায়ে মগ্ন। শেখ হাসিনা তার দলে আওয়ামী ওলামা লীগ প্রতিষ্ঠা করেছেন। তারা জামায়াতে ইসলামীর চেয়ে আলাদা নয়। তারাও মুক্তচিন্তক এবং ব্লগারদের হত্যা সমর্থন করে।
আর্তি টিকো সিং: ভারত ১৯৮৪ সালে শিখ-বিরেধী সহিংসতার শিকার হয়েছিল। ১৯৯০ সালে কাশ্মীরি পন্ডিতদের জাতিগতভাবে নির্মূল করা হয়েছিল। ২০০২ সালে গুজরাট দাঙ্গা হয়েছিল। ভারত সরকারের নিজস্ব স্বীকারোক্তি অনুযায়ী ভারতে জাতিগত সহিংসতা এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা কয়েক বছরের তুলনায় বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০১৫ সালে তিনজন নাস্তিক খুন ও দুইজন মুসলিম বালকের মৃতুদ- দেয়া হয়েছে। ভারতে সংখ্যাগরিষ্ঠের সহিংসতার শিকার হওয়া সংখ্যালঘুদের পরিস্থিতি বাংলাদেশের চেয়ে ভিন্ন কি?
তসলিমা নাসরিন: ইসলামী মৌলবাদীরা একের পর এক বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের টার্গেট করে যাচ্ছে। হিন্দুদের লাঞ্চিত করা, মারধর করা এমন কি খুন করা হয়েছে। হিন্দু তরুণীকে ধর্ষণ করা হয়েছে, তাদের সম্পত্তি কেড়ে নেয়া হয়েছে। হিন্দুদের দেশ ছাড়তে বলা হচ্ছে। ১৯৪৭ সালে বাংলাদেশে হিন্দুর সংখ্যা ছিল ৩১ ভাগ বর্তমানে যা ৮ ভাগ।
আমি মনে করি না বাংলাদেশে হিন্দুরা যতটা নির্যাতিত হয় ভারতে মুসলমানরা অতটা নির্যাতিত হয়। কট্টরপন্থী হিন্দুরা মুসলমানদের ঘৃণা করলেও ভারতের সংবিধান ধর্মনিরপেক্ষ, যা ধর্ম, বর্ণ, জাত, লিঙ্গ নির্বিশেষে সবার জন্য সমান অধিকার নিশ্চিত করেছে। ভারতের মুসলমানরা শিক্ষা এবং চাকরি ক্ষেত্রে অনেক সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে। বাংলাদেশে হিন্দুদের সংখ্যা ক্রমাগত কমছে। কারণ দেশভাগের পর থেকে তারা বাংলাদেশ ত্যাগ করছে। হিন্দুরা বাংলাদেশে আর ফিরে যাচ্ছে না। ভারতে মুসলমানরা প্রায়ই হিন্দুদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাড়াঁয়। সমতা আছে বলেই এটি করতে পারছে।
হিন্দুরা তাদের জীবন বাচাঁনোর জন্য বাংলাদেশ ছাড়ছে। কিন্তু ভারতীয় মুসলমানরা তাদের দেশ ছাড়ার প্রয়োজন মনে করছে না। তারা ভারতেই সন্তুষ্ট।
আর্তি টিকো সিং: পাকিস্তান ইসলামী জঙ্গীবাদের শিকার। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশের পরিস্থিতি পাকিস্তানের চেয়ে আলাদা করা যায় কি?
তসলিমা নাসরিন: বাংলাদেশ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে জন্ম নিয়েছিল। এর সংবিধানও ধর্মনিরপেক্ষ। আর পাকিস্তান ইসলামী প্রজাতন্ত্র। কিন্তু বাংলাদেশ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হয়েও এখন এটি ইসলামপন্থীদের কারণে আতঙ্কে পরিণত হচ্ছে। কারণ চল্লিশ বছর ধরে এটিকে ইসলামীকরণ করা হয়েছে। এর রাজনৈতিক ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ইসলামিক। বাংলাদেশে যতগুলো ইসলামি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে কোন মুসলিম রাষ্ট্রেও আপনি ততটা দেখতে পাবেন না।
সম্প্রতি বাংলাদেশে ইসলামপন্থীরা অনেক লেখক, ব্লগার এবং মুক্তচিন্তককে খুন করেছে। একজন খুনিও সাজা পায় নি। কিন্তু ধর্মান্ধরা পাকিস্তানের প্রগতিশীল লেখক সালমান তারসীকে খুন করলে অপরাধীকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছিল। পাকিস্তানে কিছুটা হলেও বিচার আছে, যা বাংলাদেশে নেই। তাই দেশটি এখন ইসলামী জঙ্গীদের শান্তির স্বর্গে পরিণত হয়েছে। এমনকি সিরিয়া এবং ইরাকও বাংলাদেশের মত ইসলামী মৌলবাদীদের জন্য নিরাপদ নয়। কারণ এদেশের আকাশে জঙ্গীদের বিরক্ত করার মত কোন বোমারু বিমান বা ড্রোন ঘুরে না।
এদেশের সরকার মুক্তমনা এবং ব্লগারদের সুরক্ষা করার বদলে তাদেরকে নাস্তিকতাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে লিখতে বারণ করে। নাস্তিকদেরকে আইসিটির ৫৭ ধারায় আটক করা হয়েছে। মুক্তচিন্তার বিরুদ্ধে নতুন আইন জারি করা হয়েছে।
আর্তি টিকো সিং: সাম্প্রদায়িক সংঘাত এবং বিভক্তির কারণেই ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়ে তিনটি দেশের (বাংলাদেশ, ভারত এবং পাকিস্তান) জন্ম। ১৯৪০ সালে মুক্তিযোদ্ধারা এই সাম্প্রদায়িক দ্বন্দের কারণেই যুদ্ধ করেছিল। জন্মলগ্ন থেকেই এই রাষ্ট্রগুলো কি উপযুক্ত নীতি নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে? এটি বাংলাদেশ সৃষ্টিতে কতটা সহায়ক হয়েছে?
তসলিমা নাসরিন: ভারতবর্ষ বিভক্তি একটি বড় ভুল। ভারতের পার্শ্ববর্তী দুই দেশ এখন ইসলামী মৌলবাদিদের অধীনে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের ১৯৭১ সালের যুদ্ধ প্রমাণ করে যে, মুসলিম জাতীয়তাবাদ অতিরঞ্জিত ধারণা এবং জিন্নাহ’র দ্বি-জাতি তত্ত্ব ভুল। বাংলাদেশ নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয় নি। দুর্নীতিগ্রস্ত শাসকরা এটিকে ইসলামীকরণ করেছে। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের সবচাইতে জঘন্য মুসলিম রাষ্ট্র। বাংলাদেশের মত একটি প্রতিবেশী দেশ ভারতের জন্যও সুবিধের নয়। এদেশে থেকে আল-কায়েদা, আইএস এবং ইসলামিক জঙ্গিরা ভারতে এসে কখন যে অসহায় নাগরিকদের হত্যা করবে বলা যায় না। বাংলাদেশ পুরোপুরি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। সন্ত্রাসীদের জন্য এটি এখন প্রজননস্থলে পরিণত হতে যাচ্ছে।
আর্তি টিকো সিং: আপনি ভারতীয় উদারপন্থী এবং বামপন্থীদের কঠোর সমালোচনা করেছেন, কেন?
তসলিমা নাসরিন: আমি ভারতীয় উদারপন্থী এবং বামপন্থীদের কঠোর সমালোচনা করেছি। কারণ আমি দেখেছি তারা শুধু হিন্দু উগ্রবাদের সমালোচনা করে কিন্তু ইসলামী উগ্রবাদের না। ইসলামী উগ্রবাদ মানবাধিকার, নারী অধিকার, বাক-স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্রের পরিপন্থী। ইসলামী মৌলবাদ উদারপন্থীদের বিরুদ্ধে। কিন্তু বামপন্থীরা তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল। এভাবেই তারা ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণা বিকৃত করেছে।
আর্তি টিকো সিং: আপনি সবধর্মের বিরোধীতা করেন। আপনি কি কখোনো ভেবেছেন, ধর্মের সমালোচনা অকারণে মানুষকে উত্তেজিত করে এবং সাধারণ ধর্মানুসারীদের কট্টরপন্থী হতে বাধ্য করে?
তসলিমা নাসরিন: আমি এটি মনে করি না। মুক্তচিন্তক, যুক্তিবাদী, নাস্তিক, মানবতাবাদী সমাজের অন্যান্য মানুষেরই একটি অংশ। সংযমী ধর্মানুসারীদের সমালোচনার প্রয়োজন নেই এবং তারা কট্টরপন্থীও হবে না। রাজনৈতিক কারণই মানুষকে কট্টরপন্থী করে তোলে। ধর্মের সমালোচনা মানুষকে সঠিক যুক্তিকে বেছে নিতে সাহায্য করে নয়তো তারা অন্ধের মত বিশ্বাসীতে পরিণত হয়। সমাজে ধর্মের সমালোচনার সুযোগ না থাকলে আমরা অবশ্যই একটি রাষ্ট্রকে ধর্মনিরপেক্ষ বলতে পারি না। এটি একটি সুস্থ সমাজের জন্য অতি প্রয়োজনীয়। সব ধর্মেরই বিচার-বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন আছে। বাংলাদেশে কট্টরপন্থীরা নাস্তিক এবং যুক্তিবাদীদের হত্যা করছে। তারা কট্টরপন্থী কারণ তারা খুব অল্প বয়স থেকেই ইসলামীক ধ্যান-ধারণাকে ধারণ করে আসছে। তাদের বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন এবং সহনশীল দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজন।