সোমবার, ০৫ Jun ২০২৩, ১১:৪৩ অপরাহ্ন
মুহাম্মদ জামাল উদ্দিন : বাংলা সাহিত্যে রীন্দ্রনাথ একচ্ছত্র কবি সম্রাট। রবীন্দ্রনাথ কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, প্রবন্ধকার, শিক্ষাবিদ, ভাষাবিদ, নাট্যকার, নীতিকার, চিত্রকর, অভিনেতা সুরকার, গায়ক, দার্শনিক ইত্যাদি ক্ষেত্রে শিখরস্পর্শী প্রতিভার অধিকারী। কেবল তাই নন- তিনি একজন সমাজ সংগঠক, সমাজ সংস্কারক আবার তিনিই একজন জমিদার ও ব্যবসায়ী। কৃষকদের কল্যাণের জন্য তিনিই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কৃষিব্যাংক। তার সাথে তুলনা যোগ্য কবি-সাহিত্যিক বিশ্বসাহিত্যে বিরল। এক কথায় বরীন্দ্রনাথ বিশ্বসাহিত্যে একটি অপ্রতিদ্বন্দ্বী ও একক প্রতিভা। উল্লেখিত সকল কাজই তিনি নির্দ্বিধায় ও স্বাচ্ছন্দে চালিয়ে যেতেন।
তার গানে পৃথিবীর সমস্ত দুঃখ-বেদনাকে অতিক্রম করে এক অতল আনন্দলোকে প্রবেশ করার আকাঙ্খা প্রকাশিত হয়েছে। জানা যায়, মন ও মনের একঘেঁয়েমি তাড়ানোর জন্যই তিনি রচনা করতেন গান। মূলত সাধনা ও ধৈর্য্য ছিল অপ্রতিরোদ্ধ এবং এ কারণেই তার পক্ষে এত বিশাল ও বিপুল সাহিত্য সৃষ্টি সম্ভব হয়েছে। এক ঐশ্বর্যময় ও সুন্দর পারিবারিক পরিবেশে বাল্যকালেই তার কাব্য চর্চার শুরু এবং মাত্র বার বছর বয়সেই তিনি রচনা করেন “পৃথ্বিরাজ’ ও ‘বনফুল” কাব্য। আগে থেকেই তিনি “ভারতী” পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন কিন্তু ১৮৯১ খ্রীস্টাব্দে “সাধনা” নামে একটি পত্রিকাও প্রকাশ করেছেন। মোট কথা, তিনি আজন্ম আদর্শবাদী ও মানবতাবাদী বিশ্ববিজয়ী বরেন্যপুরুষ মানব- কল্যাণ ও সুন্দরের অন্বেষায় আজীবন সাধনা করেছেন।
কবিতায় রবীন্দ্রনাথ দেহ থেকে দেহাতীত এবং রূপ থেকে রূপাতীত এক অপূর্ব ভূবনে বিচরনের চেষ্টা করেছেন। একটি শাশ্বত ভাবনা তার কব্যগুলোকে সর্বদা মহিমান্বিত করেছে। তাই কবিতার জগতে রবীন্দ্রনাথ বিশ্বের যে কোন কবিকে ছাড়িয়ে সাফল্যের সুউচ্চ শেখড়ে উডডীন তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। কবিতায় তার অনুপম দর্শন ও মননশীলতার কথা বলাই বাহুল্য। তার কবিতায় স্বদেশ প্রেম, লোকপ্রেম, জীবনপ্রেম, জীবনবোধ, প্রকৃতিপ্রেম, ¯্রষ্টা ভক্তি ইত্যাদি যাবতীয় দিক উন্মোচিত হয়েছে শত শত ধারায়। কবিতা ও গানই যেন তার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ আলোক বর্তিকা। প্রাণের সংগে পৃথিবীর সেতু বন্ধন, প্রাণের অন্তরে অন্তরে সৌরভ মুখরিত কুসুমের বিকাশ, জীবনবোধের অনন্য ও অপ্রতিরোদ্ধ অফুরান অবিনাশী বরাভয় আহবান তার কবিতার ছত্রে ছত্রে। মানুষের চাওয়ার সাথে পাওয়ার ব্যবধান বিস্তর। ইসলামের ভাষায় ইহা চির সত্য। পবিত্র কোরআনের সুরা বাকারায় ২১৬ আয়াতে আল্লাহ বলেন- “তোমরা যা মন্দ ভাব তা তোমাদের মঙ্গলের আর যা ভাল ভাব তা অকল্যাণকর; আল্লাহ সবকিছু জানেন, তোমরা কিছুই জান না।” মানুষ অযথাই আস্ফালন করে মাত্র। তাই রবীন্দনাথ বলেন- “নদীর এপারে কহে ছাড়িয়া নিশ্বাস/ওপারেতে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস”। পরিবতির্ত ক্ষেত্রে কবি বলেন- কে লইবে মোর কার্য কহে সন্ধ্যারবি।/শুনিয়া জগৎ রহে নিরুত্তর ছবি। মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল, স্বামী/আমার যেটুকু সাধ্য করিব তা আমি।
কুপোষ্য বা কৃপনতা ও বিশ্বাস ঘাতকতা বুঝাতে রবীন্দ্রনাথ বলেন “শৈবাল দিঘিরে বলে উচ্চ করি শির,/ লিখে রেখো, এক ফোঁটা দিলেম শিশির। অথবা কেরোসিন শিখা বলে মাটির প্রদীপে,/ভাই বলে ডাকো যদি দেব গলাটিপে,/হেনকালে গগনেতে উঠিলেন চাঁদা,/কেরোসিন বলি উঠে- এসো মোর দাদা।
এসব কবিতা বাংলা সাহিত্যের অমর ও অবিনশ্বর সম্পদ। এরূপ কবিতা গুলো বাংলা সাহিত্যের প্রচলিত রূপকথা বা প্রবাদ প্রবচনের মতই চিরস্থায়ী আসনে আসীন। এ কবিতাংশগুলো দ্বারা সুষ্পষ্ট প্রতিয়মান হয় যে, তার দর্শন শক্তি অপর সবার চেয়ে আলাদা ও একক প্রতিভায় উজ্জল। বাস্তব জীবনের সাথে কাঙ্খিত জীবনের একীভূত চিন্তার ফসল। তত্ত্ব ও তথ্যের ভারে কবিতাগুলো আবার কোথাও আড়ষ্ট হয়নি বরং ছন্দ স্পন্দে প্রানবন্ত, বাস্তব ও কল্পনায় অপরূপ সাযুজ্যে শিল্পোত্তীর্ণ। সার্থকহয়েছে- ইংরেজ কবি কোলরিজ যেমনটি বলেছেন- No man was ever a great poet without being at the same time a profound philosopher.
রবীন্দ্রনাথ বলেন- কত বড়ো আমি কহে নকল হীরাটি।/তাই তো সন্দেহ করি নহ ঠিক খাঁটি। অথবা ধ্বনিটির প্রতিধ্বনি সদা ব্যঙ্গ করি-/ধ্বনির কাছে ঋণী সে যে পাছে ধরা পড়ে। এমনি অভিজ্ঞতাকে ফুটিয়ে তুলেছেন পাঠকের চলার পথের পাথেয় হিসেবে। সমাজের কৃত্রিম চরিত্রের মানুষদের চিহ্নিত করতে সহায়তা করে। জীবনের এক তরফা হিসেব করতে দেখে তিনি বলেন- সাতাশ, হলে না কেন একশো সাতাশ/ থলিটি ভরিত হাড়ে লাগিত বাতাস।/সাতাশ কহিল, তাহে টাকা হত মেলা-/ কিন্তু কী করিতে বাপু বয়সের বেলা? আবার সমাজের একটা শ্রেণি রয়েছে যারা নিজের প্রতি কোন খেয়ালই করে না অথচ অপরের পেছনে সদা জাগ্রত। সেখানে রবীন্দ্রনাথ বলেন- আ¤্রকহে, একদিন, হে মাকাল ভাই,/আছিনু বনের মধ্যে সমান সবাই।/ মানুষ লইয়া এল অপনার রুচি,/মূল্যভেদ শুরু হল, সাম্য গেল ঘুচি।
কবিগণ মানবজীবন ও বিশ্বজীবনের মধ্যে অখম্ভতার মিল খোঁজে ফেরেন। তাই তাদের দৃষ্টি উদার ও নিরপেক্ষ। তাই নিখিল মানবতার আদর্শের প্রতি কবির প্রত্যয়নিষ্ঠ বিশ্বাস মানব ইতিহাসের নানা বিপর্যয়ে উত্তীর্ণ হয়েই তাদের অভিযাত্রা। দেশ, কাল, পাত্রের অভেদ চিন্তা তাকে অসীমের কাছে- পরম সত্যের কাছে নিয়ে যায়। পরম সত্য বা মহান ¯্রষ্টার নির্দেশিত মত ও পথকে নতুনরূপে সাজিয়ে নেয় কিন্তু প্রকৃষ্ট অনুসন্ধানকারী ¯্রষ্টার পথেই অভিভূত হন। ফলে তারাই প্রকৃত কামিয়াব হন।
রবীন্দ্রনাথ “উদার চরিত নামায়” বলেন- প্রাচীরের ছিদ্রে এক নাম গোত্রহীন/ফুটিয়াছে ছোটো ফুল অতিশয় দীন।/ধিক ধিক করে তারে কাননে সবাই-/ সূর্য উঠি বলে তারে, ভাল আছ ভাই? আবার “নিজের ও সাধারণের” কবিতায় বলেন- চন্দ্র কহে, বিশ্বে আলো দিয়েছি ছড়িয়ে,/কলঙ্ক যা আছে তাহা আছে মোর গায়ে। “মূল” কবিতায় বলেন- আগা বলে, আমি বড়ো, তুমি ছোটো লোক।/গোড়া হেসে বলে, ভাই, ভালো তাই হোক।/ তুমি উচ্চে আছ বলে গর্বে আছ ভোর,/তোমারে করেছি উচ্চ এই গর্ব মোর। “গরজের আত্মীয়তা” কবিতায় তিনি বলেন- কহিল ভিক্ষার ঝুলি টাকার থলিরে,/আমরা কুটুম্ব দোহে ভুলে গেছি ফিরে?/থলি বলে; কুটুম্বিতা তুমিও ভুলিতে/ আমার যা আছে গেলে তোমার ঝুলিতে।
সৃষ্টি ও ¯্রষ্টার মধ্যে যে অনন্তপ্রেম তা অবারিত। রবীন্দ্রনাথ ¯্রষ্টা বিশ্বাসী ছিলেন। কারণ ¯্রষ্টাকে তার সৃষ্টির মধ্যে খোঁজে পাওয়া যায়। তিনি “ভক্তিভাজন” কবিতায় বলেন- রথযাত্রা , লোকারণ্য, মহা ধুমধাম,/ ভক্তেরা লুটায়ে পথে করিছে প্রনাম।/পথ ভাবে আমি দেব, রথভাবে আমি,/ মূর্তিভাবে আমি দেব- হাসে অর্ন্তযামী।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এমন কিছু নীতিকবিতা রয়েছে যা ধর্মীয় নীতির পূনঃ সংস্করণ বা সংগতিপূর্ণ উচ্চারণ। তিনি বলেন-
অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে তব ঘৃণা যেন তাহে তৃণসম দহে। তাই রবীন্দ্রনাথ বাংলা কবিতার সেই সুবিশাল দ্বার যার মধ্য দিয়ে গ্রহণ করা যায় অতল সাহিত্যিক শ্বাস-প্রশ্বাস। তার কবিতা, গীতি কবিতা ও নীতি কবিতা আমাদের অন্তর চোখকে শাণিত করে। সীমার বাঁধন ছিন্ন করে মানুষকে নিয়ে যায় মানুষের ভেতরের মানুষের কাছে। সমাজ, দেশ ও জাতি বিনির্মাণে তার নীতি কবিতা অসামান্য ও অতল প্রয়াসী
-লেখক, কবি ও কলামিস্ট।