বুধবার, ০৪ অক্টোবর ২০২৩, ০৮:৫৭ পূর্বাহ্ন

ক্যান্সার প্রতিরোধক হিসাবে বিনামুল্যে গাছের সব পাতা দিলেন শিক্ষিত কৃষক ড. প্রিন্স

# ক্যান্সারের কোষের বৃদ্ধি রুখে দেয়
# স্তন ক্যান্সার, ফুসফুস ক্যান্সার, প্যানক্রিয়াটিক ক্যান্সার, লিভার ক্যান্সার, প্রসটেট ক্যান্সারে বেশি কার্যকর
# ফল খেতে পারলে, শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেকটা বেড়ে যায়
# ফলই নয়, এই গাছের ছাল ও পাতায় লিভার সমস্যা, আর্থরাইটিস ও প্রস্টেটের সমস্যায়ও নিরাময় হয়ে যায়

মো. আব্দুস ছাত্তার : করোসল নতুন একটি ফল/গাছের নাম। ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ায় এটি একেবারেই নতুন। এটি ক্যান্সার প্রতিরোধক। তবে এটি আবাদ করেন ফুলবাড়িয়ার এক গ্র্যাজুয়েট শিক্ষিত কৃষক ড. আবু বকর সিদ্দিক প্রিন্স। মানবিক দিক বিবেচনায় তিনি করোসল গাছের সকল ফল ও পাতা বিনামুল্যে প্রদান করবেন বলে প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন।
ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার রাঙ্গামাটিয়া ইউনিয়নের দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বদ্ধ জলাশয়ের তীরে রাঙ্গামাটিয়া গ্রামে ২০১৪ সালে ‘কৃষাণ সমন্বিত কৃষি উদ্যোগ’ নামে খামার চালু করেন ড. আবু বকর সিদ্দিক প্রিন্স। প্রায় ছয় একর জমিতে মানবদেহের উপকারি ঔষধি-ফলজ-বনজ ১৬৫ প্রকারের প্রায় ১২ হাজার গাছ রয়েছে। বাগান ঘুরে দেখা গেছে বিভিন্ন ফলের সমারোহ, এ যেন ফলের রাজ্য। প্রতিনিয়ত ৬ জন শ্রমিকের সাথে তিনিও কাজ করেন। ক্যান্সারের প্রতিষেধক হিসেবে এ ফলের পক্ষে বিশেষজ্ঞদের বিভিন্ন মতামত পাওয়া যায়। অনেক দেশেই এ ফলটি ক্যান্সার প্রতিরোধক হিসেবে পরিচিত। উদ্যোক্তা বলছেন ২০১৭ সালে তাকে কেউ একজন ফোন করে তার বোনের ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য এই করোসল ফলটি চায়। তার বোনের ক্যান্সারের চিকিৎসার পর সিঙ্গাপুরের চিকিৎসক দেশে নিয়ে কেমোথেরাপি না দিয়ে করোসল ফল খাওয়ার পরামর্শ দেন। তিনি নিজেও এই ফল সম্পর্কে ঐ সময় কিছুই জানতেন না। এরপর ইন্টারনেটে বিভিন্ন ওয়েব সাইডে করোসল বিষয়ে কিছুটা জানতে পারেন। পরবর্তীতে স্যোসাল মিডিয়ায় চারা বা বীজের সহযোগীতা চেয়ে একটি পোস্ট দেন। তার এক বন্ধু সাড়া দেয়, তখন সে থাইল্যান্ডে অবস্থান করছিলেন। থাইল্যান্ড থেকে বাংলাদেশে এসে তাকে করোসলের ৪০টি বীজ দেন ঐ বন্ধু। ৪০টি বীজ বপন করায় চল্লিশটি চারা হয় বিনামুল্যে ৩২টি চারাগাছ বিভিন্নজনে বিতরন করে, বাকী ৮টি চারা উনি বাগানে রোপন করেন। সেই গাছে ৬ বছর অপেক্ষার পর এবারই প্রথম ফল আসে। ফলগুলোর বাজার মূল্য অন্তত ৫০-৫৫ হাজার টাকা কেজি। উদ্যোক্তা ড. আবু বকর সিদ্দিক প্রিন্স ফল ও পাতা কিছুই বিক্রি করবেন না। তা মানুষের চাহিদার ভিত্তিতে দেশের কোন প্রান্তে বিনামুল্যে পৌঁছে দিচ্ছেন। তিনি ব্যবসার পাশাপাশি মানুষের জন্য কিছু করতে চান, এই অভিপ্রায় হতে তিনি সামাজিক কিছু কাজকর্ম করেন।
করোসল (corossol) ফলের অনেকগুলো নাম রয়েছে। সেগুলো হলো- গ্র্যাভিওলা, (Graviola), সোরসপ, গুয়ানাভা ও ব্রাজিলিয়ান পাও পাও। এই ফলের জন্য গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চল বেশ উপযোগী। চায়না, অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকা, ব্রাজিল, মেক্সিকো প্রভৃতি দেশে এই ফল খুব ভালো জন্মে। এ ফল শীতপ্রধান অঞ্চলে বাঁচতে পারে না।
করোসল ফলের গাছটি ২৫-৩০ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট এবং স্বল্প শাখা-প্রশাখাযুক্ত হয়ে থাকে। এর ফলটি দেখতে ক্রিকেট খেলার স্টেডিয়ামের মতো ওভাল আকৃতির হয়ে থাকে। গায়ে বৃন্তযুক্ত, হলদেটে সবুজ রঙের ফলটির ভক্ষণযোগ্য অংশটি জ্যুসি। এই ফলটি আতা ফলের মতো খাওয়া ছাড়াও পানীয় এবং শরবত হিসেবে গ্রহণ করা যায়।
করোসল ফলের ঔষধি গুনাগুণ : বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই ফল ক্যান্সার প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে। এই ফল খেলে ক্যান্সাররোগীর কেমোথেরাপির প্রয়োজন হয় না। এ ফল ক্যান্সার সেলের মৃত্যু ঘটাতে কেমোথেরাপির চেয়ে এটি ১০ হাজার গুণ বেশি শক্তিশালী।
করোসল গাছে রয়েছে অ্যানোনাসিয়াস অ্যাস্টোজেনিন নামে এক ধরনের যৌগ। এই যৌগ ক্যান্সারের কোষের বৃদ্ধি রুখে দেয়, যা কেমোথেরাপি করে। ফলে ক্যান্সার কোষ আর বাড়তে পারে না। বিশেষ করে স্তন ক্যান্সার, ফুসফুস ক্যান্সার, প্যানক্রিয়াটিক ক্যান্সার, লিভার ক্যান্সার, প্রসটেট ক্যান্সারে এটি বেশি কার্যকর।
এছাড়া নিয়মিত এই ফল খেতে পারলে, শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেকটা বেড়ে যায়। শরীরও চাঙ্গা থাকে এবং দুর্বল ভাব আসে না। রক্তকে শোধিত করতেও এই ফলের গুণ অনস্বীকার্য। শুধু ফলই নয়, এই গাছের ছাল ও পাতায় লিভার সমস্যা, আর্থরাইটিস ও প্রস্টেটের সমস্যায়ও নিরাময় হয়ে যায়।
মাটি : করোসল ফলের জন্যে ৫-৬.৫ ঢ়ঐ মাত্রার মাটি সবচেয়ে উপযোগী। মাটিতে নিষ্কাশন ব্যবস্থা ভালো থাকতে হবে। বেলে মাটি এই ফলের জন্যে উপযুক্ত হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
বীজসংগ্রহ ও চারা উৎপাদন : করোসল (corossol) মাঝ বরাবর কেটে বীজ সংগ্রহ করতে হয়। একটি ফলে মোটামুটি ১২-২০ টি বীজ থাকে। এরপর ঘরের অভ্যন্তরে ছায়াযুক্ত স্থান নির্বাচন করে অঙ্কুরোদগম হওয়ার জন্যে সুযোগ দেওয় হয়। কুসুম গরম পানিতে বীজকে ২৪ ঘন্টা ভিজিয়ে রাখতে হয়। পরদিন একটি ট্রেতে কোকোডাস্ট, ভার্মিকুলাইট মিশিয়ে পিট তৈরি করে বীজ বপন করতে হয়। ২-৪ সপ্তাহ পর বীজের ট্রেটিকে আলোর সংস্পর্শে নিয়ে আসতে হবে। প্রতিদিন ৪-৬ ঘন্টা সূর্যের আলোর সংস্পর্শে রাখা বাঞ্ছনীয়। করোসলের বীজ ১৫-৩০ দিনের মধ্যেই অঙ্কুরিত চারা টবে রোপণের উপযুক্ত হয়ে যায়।
অঙ্কুরিত বীজটিকে এবার টব বা প্লাস্টিকের পাত্রে স্থানান্তরিত করতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে পাত্রটি যেন গাছের চেয়ে বড় হয়। পাত্রের নিচে ছিদ্র থাকতে হবে। মোটামুটি ১ মাসে মধ্যেই চারাগাছ টবে লাগানোর উপযুক্ত হয়ে যায়। টব বা প্লাস্টিকের পাত্রটি পটিংমিক্স দ্বারা পরিপূর্ণ থাকতে হবে। ট্রে থেকে খুব সতর্কতার সাথে চারা তুলে নিতে হবে যেন শিকড় ক্ষতিগ্রস্থ না হয়। শেকড় ক্ষতিগ্রস্থ হওয়া করোসলের জন্যে বেশ ঝুকিপূর্ণ। এভাবে ৬ মাস বাড়তে দিতে হবে চারাকে।
চারা লাগানোর সময় : ফাল্গুন মাসের শুরুতে বা বসন্তে করোসলের চারা লাগানোর উপযুক্ত সময়।
চারা রোপনের নিয়ম : অঙ্কুরিত বীজটি বাগানে লাগানোর পূর্বে এর পরিবেশ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এমন একটি জায়গা নির্বাচন করতে হবে যেটি দক্ষিণমুখী, সূর্যের আলোযুক্ত স্থান। স্থানটি বাতাস সুরক্ষিত হওয়া অবশ্য জরুরী। করোসল গাছের শাখা-প্রশাখা বেশ ছোট হয়, ঝাপটা বাতাসে এর কান্ড ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এজন্যে গাছ রোপণের জন্যে এমন স্থান নির্বাচন করা জরুরী যেখানে পেছনে দেওয়াল বা কোনো ভিত্তি আছে। যাতে বাতাস বেরিয়ে যাবার পথ না থাকে।
বীজ লাগানোর পূর্বে মাটি ঝরঝুরে করে নিতে র‌্যাকার চালাতে হবে, ২ ইঞ্চি পুরু করে কম্পোস্ট সার দিয়ে মাটি তৈরি করে নিতে হবে। ১২ ইঞ্চি চারাটি রোপণের ক্ষেত্রে একটি গাছ থেকে অপর গাছেত দূরত্ব হতে হবে ১২ ইঞ্চি। নইলে গাছ উপযুক্ত পুষ্টির অভাবে বেড়ে উঠতে পারবে না। গর্ত বড় করে করতে হবে যেন মূল গভীর পর্যন্ত যেতে পারে। মাটি দিয়ে ঢেকে দেওয়ার পর ৩ ইঞ্চি পুরু করে কচুরিপানা দিয়ে ঢেকে দিতে হবে আর্দ্রতা ধরে রাখতে।
সেচ : করোসল (corossol) ফলের গাছটি নিজেই নিজের আর্দ্রতা ধরে রাখতে পারলেও গ্রীষ্মকালে একে আলাদা সেচ দিতে হয়। শীতকালে অতিরিক্ত সেচ দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। করোসল গাছ খরা সহিষ্ণু। তবে মাটি আর্দ্র থাকার ফলে পোকামাকড়ের সংক্রমণ বেশি দেখা দেয়।
সার প্রয়োগ করোসল গাছে নাইট্রোজেন : ফসফরাস : পটাসিয়াম = ১:১:১ অনুপাতে ৩ কিস্তিতে সার প্রয়োগ করতে হয়। প্রথম বছর একটি গাছের জন্যে হাফ পাউন্ড ( অর্থাৎ ২২৭ গ্রাম ) পরিমাণ সার সমান ৩ ভাগে বিভক্ত করে ৪ মাস পর পর প্রয়োগ করতে হবে।
দ্বিতীয় বছর ১ পাউন্ড ( অর্থাৎ ৪৫৪ গ্রাম ) সার একইভাবে প্রয়োগ করতে হয়। তৃতীয় বছর থেকে প্রতিবছর ৩ পাউন্ড (অর্থাৎ ১৩৬২ গ্রাম) সার প্রয়োগ করতে হয়।
করোসল গাছের যত্ন : দ্বিতীয় বছরে গাছের কেন্দ্রীয় অগ্রপ্রান্ত ৩ ভাগের ১ ভাগ অংশ কেটে ফেলতে হবে।
এরপর কাটা অংশের নিচ হতে নতুন শাখা গজানো পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এটি দ্বিতীয় লম্বালম্বি শাখা তৈরি করতে সহায়তা করবে। এতে সংখ্যায় ফল বেশি পাওয়া যাবে একটি গাছ থেকে।
৩-৫ বছরের মধ্যে গাছে ফুল ধরা শুরু করবে। করোসল অনেক ধীর প্রজাতির উদ্ভিদ। ধৈর্য্য ধরতে হবে এর আকাশচুম্বী মূল্য ও ঔষধিগুণের জন্যে হলেও। এটি ফুল ধরা শুরু করলে প্রতিবছর ফল দিবে নিশ্চিন্তে।
ফল সংগ্রহ : তিন-পাঁচ বছরের মধ্যেই গাছে করোসল ধরে। একেকটি করোসল গাছে ২৫০ গ্রাম-২.৫ কেজি আকৃতির ফল পর্যন্ত ধরে। করোসল হলদে সবুজ হওয়ার সাথে সাথেই সংগ্রহ করে নেওয়া শ্রেয়। একে গাছে নরম হতে দেওয়া উচিত না। এতে ফল বাজারজাতের সময় ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে। ফল সংগ্রহের ৫-৬ দিনের মধ্যেই খেয়ে ফেলা শ্রেয়। এরপর এটিতে পচন ধরা শুরু করে। অনেক দিন প্রিজার্ভের জন্যে জ্যুস, পালপ তৈরি করে নেওয়া যেতে পারে।
উদ্যোক্তা ড. আবু বকর ছিদ্দিক বলেন, নেট দুনিয়ায় হঠাৎ করে করোসল গাছের পাতার চাহিদা রেড়ে যায়। আমি আজকে পর্যন্ত ৭০ জনের কাছে নিজে টাকা খরচ করে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে পার্সেল পাঠাই, এখন গাছ মরা গাছের মত হয়ে গেছে আবার গাছও বাঁচাতে হবে। প্রতি গাছে ১২টি পাতা রেখে বাকী সবগুলো পাতা বিতরন করে দিয়েছি।
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডাক্তার হারুন আল মাকসুদ বলেন, আমি চিকিৎসা শাস্ত্রে এমন কিছু পাইনি, তবে করোসল গাছে রয়েছে অ্যানোনাসিয়াস অ্যাস্টোজেনিন নামে এক ধরনের যৌগ। এই যৌগ ক্যান্সারের কোষের বৃদ্ধি রুখে দেয়, যা কেমোথেরাপির মত কাজ করে। ফলে ক্যান্সার কোষ আর বাড়তে পারে না। নিয়মিত এই ফল খেতে পারলে, শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেকটা বেড়ে যায়।

Please Share This Post in Your Social Media

কপিরাইট © ফুলবাড়িয়ানিউজ২৪ ডট কম ২০২০
Design & Developed BY A K Mahfuzur Rahman