ঘুমন্ত মুসলিম জাতির নিদমহলে আঁধারপুরে নজরুল দিলেন ভোরের আযান। কোন দ্বিধা নেই, কুন্ঠা নেই, জড়তা নেই, নেই কোন কূটতর্ক। মুসলিম বাংলার মানস জমিনে গুলিস্তানের বুলবুলি হয়ে জেগে উঠলেন। একেবারে আনকোরা, নিজস্ব ধ্যান-ধারণা, চিন্তা-চেতনা, আশা-আকাঙ্খার তূর্য হাতে ডাকদিলেন বাংলা আর বাঙালীকে। সমকালে তিনিই একমাত্র কবি এবং গীতিকার ও সাহিত্যিক যিনি অন্যায় অত্যাচারের উৎক্রম উত্তরদায়ক। সেকেলে ধ্যান-ধারণা ও সকল প্রকার রক্ত চু শাসক, কাফের ফতোয়ার জিলতি উপো করলেন। পশ্চাদমুখী বাঙালী মুসলিম সমাজের অন্তরে বাইরে পরিয়ে দিলেন ইসলামের নিগূঢ় ও তাত্ত্বিক মূল্যবোধের আলোক রাখি। ইসলামের স্বাতন্ত্রমোহিনী শক্তির নির্যাস পুষ্প ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিলেন মানুষের মূর্ত চেহারায়। অবাধে অসংকোচে নিজের আসন গড়ে নিলেন মানুষের অন্তরের মনিকুঠায়।
গানের জগতে কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন একাধারে গীতিকার, গায়ক ও সুরকার। তিনি তাঁর মসীকে অসি করে ুরধার লেখনীর আঁচরে বাংলা গানে ইরান, ইরাক, আফগান, মিশর এবং ইসলামের উদয় আকাশ আরবের আতর আমেজে উজ্জীবিত করলেন বাঙালী মুসলিম জাতিকে। রচনা করলেন অসংখ্য হামদ, নাত, গজল, আর বিমোহিনী গান। গানে গানে জাতিকে দিলেন নতুন প্রাণ, পথ চলায় নতুন গতি, জাগালেন নিগূঢ় ধর্মীয় প্রেম, উন্মোচন করলেন ধর্মীয় মূঢ়তার বেড়াজ্বাল। ইসলামের রন্দ্রে রন্দ্রে তাঁর শিা আদর্শকে লেপে দিলেন। রূপ রস অন্বেষা ও প্রেমানুভূতির আধ্যাত্মিক সৌন্দর্য কীর্তনে ব্যাকুল ও বিহবল হলো মানুষের চিত্তাকাশ। তিনি গাইলেন-ত্রিভুবনের প্রিয় মোহাম্মদ এলোরে দুনিয়ায়/ইসলামের ঐ সওদা লয়ে এলো নবীন সওদাগর/তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে……..। রসুল নামের ফুল এনেছি গাঁথবি মালা কে/মোহাম্মদ মোর নয়নমনি মোহাম্মদ মোর জপমালা ইত্যাদি অসংখ্য গজল। উপমহাদেশে বাঙালী মুসলিম রেনেসাঁ পূর্ব বা উত্তর কালের কোন কবি বা গীতিকারের পে এমন অনন্য ও অপূর্বমোহিনী নাত বা গজল বাংলাভাষায় ইতিপূর্বে কেউ সৃষ্টি করেননি- যা একমাত্র সম্ভব হয়েছিল কাজী নজরুল ইসলামের পইে। কবি গোলাম মোস্তফার ‘বিশ্ব নবী’ মীর মোশাররফ হোসেনের ‘বিষাদ সিন্ধু’ ইত্যাদি শিতি বাঙালী মুসলমানদের হৃদয়কে স্পর্শ করেছিল,
ইসলামী মনোজগতকে, মানবতার জগতকে সম্প্রসারিত ও বিকশিত করেছিল কিন্তু কাজী নজরুলের এসব গান ও গজল ধনী-দরিদ্র, শিতি, মুর্খ সকল স্তরের মানুষের ভেতরের মানুষকে স্বতঃস্ফুর্ত করে ইসলামী মনোবলকে সুদৃঢ় করে ইসলামী জাগরনের বন্যায় বাংলাকে বিধৌত করেছিল। নিজেকে মক্কা ও মদিনার সংযোগ পথ, হাতকে মসজিদের ঝাড়–বর্দার, চোখের জলে মরুর বুকে নদী বইয়ে দেয়া, পূবের হাওয়ার কাছে সালাম প্রেরণ, কালমা শাহাদতে খোদার জ্যোতিদর্শন ইত্যাদি উপমা ও অপূর্ব প্রয়োগ নিতান্তই কালজয়ী ঘটনা। ইসলামের প্রতি, বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এর প্রতি আনাড়ী ও শিতিমুর্খ মানুষদের চোখ খোলে গিয়েছিল তাঁর এসব প্রয়োগ দেখে। তারা ইসলামকে ও ইসলামের নবীকে হৃদয় দিয়ে অন্তর দিয়ে, ভেতরকার সত্তা দিয়ে উপলব্ধি করতে শিখেছিল। সংস্কার ও পরিমার্জন এসেছিল তাদের ইসলামী আকিদায়। ইসলামের দ্বারাই কেবল পৃথিবীতে প্রকৃত শান্তি আসতে পারে এটা তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন।
তাই তাঁর কন্ঠে শুনি-
* আল্লাহতে যার পূর্ণ ইমান কোথা সে মুসলমান-।
* তৌহিদেরি মুর্শিদ আমার মুহাম্মদের নাম-।
* খোদার প্রেমের শরাব পিয়ে-।
*রোজ হাসরে আলাহ আমার করোনা বিচার-ইত্যাদি।
বিশ্ব স্রষ্টা মহান আল্লাহ পাকের প্রতি তাঁর যে, অসীম, অকৃত্রিম ও নিগুঢ় নির্মল প্রেমের নিদর্শন তা বাংলা গানে কাজী নজরুল ইসলামের পূর্বে কেউ ব্যক্ত করেছেন বলে জানা নেই। তাঁর এই প্রেম প্রকাশের বানীভঙ্গি (Style) জীবনরস নীতি (Art for life sake), মহিময়তা (Sublimity) ছন্দ (Rhyme), অতীন্দ্রিয়তা (Mystic) ইত্যাদির প্রয়োগ অতীব প্রজ্ঞাময় এবং অনন্য সাধারণ ও অপূর্ব। কালমা শাহাদতে থাকে খোদার জ্যোতি অথবা বে আমার কাবার ছবি অথবা শোন শোন ইয়া ইলাহি আমার মোনাজাত- এ ধরনের ইসলামী গানগুলো তারই প্রমাণ বহন করে। কারও কন্ঠে এসব গান আত্মনিবিষ্ট চিত্তে হৃদকর্ণ পেতে শুনতে থাকলে সত্যি সত্যি নিজেকে স্রষ্টার সমীপে নিবেদন করা সম্ভব হয়। সত্যিকার অর্থে বাঙালী মুসলিম জাতির অব্যক্ত হৃদয়ের প্রতিধ্বনি হলো তাঁর এগানগুলো।
মূল কথা- সৃষ্টি ও স্রষ্টার মধ্যকার অনির্ণীত ও নিগূঢ় সম্পর্ককে তিনি তার গানের মাধ্যমে নির্ণয় করে বিশ্ব মানবতার মানবচে ফুলে ফুলে ছড়িয়ে দিয়েছেন। ক্যান্ট সত্যই বলেন যে, সীমাহীনের ইঙ্গিতের মধ্যেও Thought of its totality বা পূর্নাবয়ব কল্পনা থাকতে পারে। শুধু তাই নয়-সহানুভূতির দৃষ্টি-প্রদীপ কামনায় অখন্ড দৃষ্টির সাহায্যে বিশ্ব-সৃষ্টির পরম সত্যকে প্রত্য করার পরম আনন্দের বিজয় সূচিত হয় তাঁর গানে।
সেই সাথে বোধি-দৃষ্টি অনন্ত সত্তার সাথে প্রশান্ত মানবসত্তার বিভেদ তিরোহিত করে। তাঁর গান আধ্যাত্মবোধের সৌন্দর্য চেতনায় বিমোহিত করে তুলে। হৃদয়ের রক্ত কণিকায় উন্মোচিত হয় অলৌকিক ও শাশ্বত প্রেম।
তাই কাজী নজরুল ইসলামের ইসলামী গানগুলো বিশ্ব রহস্যের কালো পর্দা ছিন্ন করে পরমাত্মা ও মহান আল্লাহর অস্তিত্ব চৈতন্য সম্পর্কে ভাবতে শেখায়। বিশ্ব জগত ও আত্মজগতের মধ্যে যেন এক শরীরী চৈতন্য সৃষ্টি করে ইসলামের মহত্ব ও প্রকৃত মূল্যবোধকে বিশ্বজনের কাছে ছড়িয়ে দেয়ার তাগিদ নিদের্শ করে।
-লেখক, কবি ও কলামিস্ট।
আপনার মতামত লিখুন :