পদ্মায় জাগল স্বপ্ন


প্রকাশের সময় : অক্টোবর ১, ২০১৭, ৮:০৬ AM
পদ্মায় জাগল স্বপ্ন

Padda-01

ইন্টারনেট : গতকাল শনিবার ওঠা সূর্যটার মধ্যে যেন ছিল বাড়তি আনন্দের ঝিলিক। ভোরের আলো ফোটার আগ থেকে প্রমত্তা পদ্মায়ও ছিল উচ্ছ্বাসের ঢেউ। কারণ এই দিনেই দৃশ্যমান হচ্ছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু। পদ্মা বুঝতে পারছিল কোটি কোটি মানুষের স্বপ্ন পূরণের দিন এটি। গোটা বিশ্ব তাকিয়ে আছে দিনটির অপেক্ষায়। সকালের আলো-ঝলমল আকাশ প্রথমে সাদর সম্ভাষণ জানায়। তারপর মুষলধারায় বৃষ্টি সিক্ত করেছে বাংলাদেশের অনিন্দ্যসুন্দর পথচলাকে।

দুর্নীতির মিথ্যা অভিযোগে বিশ্বব্যাংকসহ দাতা সংস্থাগুলো মুখ ফিরিয়ে নিলে অনেকের সংশয় ছিল, সেতু আলোর মুখ দেখবে তো। কিন্তু না, কারো কাছে মাথানত না করে বুক উঁচিয়ে পদ্মায় জেগে উঠতে থাকে পিলার। ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর থেকে শুরু হওয়া মূল কাজের একটা স্মরণীয় অধ্যায় ছিল গতকাল। কারণ এ দিনটিতেই সকাল ৮টায় কাজ শুরু করে ১০টার মধ্যে সেতুর জাজিরা প্রান্তে ৩৭ ও ৩৮ নম্বর পিলারের ওপর প্রথম স্প্যান বসানো হয়। এভাবেই বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দেয়, আমরা মাথা নোয়ানোর জন্য নই; নিজেরাই পারি পদ্মা সেতু গড়তে।
সেতু দৃশ্যমান হওয়ার পর ওই এলাকায় মানুষের মধ্যে আনন্দোচ্ছল পরিবেশ দেখা গেছে। স্প্যান বসানোর দৃশ্যটি দেখার জন্য অনেক মানুষ নৌকায় করে প্রকল্প এলাকায় আসেন। তবে নিরাপত্তার স্বার্থে কাছে আসতে না দিলে দূর থেকেই সবাই সাক্ষী হন ঐতিহাসিক এ মুহূর্তের। গতকাল ভোর থেকেই সেতুর স্প্যান বসানোর কাজের সাক্ষী হতে ঢল নামে হাজারো মানুষের। সবার চোখে-মুখে স্বপ্নপূরণের ছাপ।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে ফিরে স্প্যান বসানো উদ্বোধন করবেন। তবে এ জন্য সেতুর কাজ এক মুহূর্তের জন্য বন্ধ থাকবে না। তাই ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্যরে এই প্রথম স্প্যানটি আনুষ্ঠানিকভাবে বসানো হয়েছে। সেতুর ৪২টি পিলারের ওপর ৪১টি স্প্যান বসবে। গতকাল প্রথম স্প্যান বসানো হলেও মাওয়ার কুমারভোগে আরও ৯টি স্প্যান তৈরি রয়েছে, আর চীনে তৈরি আছে আরও ১২টি। এগুলো পর্যায়ক্রমে আনা হবে। এ ছাড়া বাকি ১৯টি স্প্যান চীনে তৈরির প্রক্রিয়া চলছে। এই স্প্যানের মাঝ বরাবর নিচের লেনে চলবে ট্রেন; উপরে কংক্রিটের চার লেনে চলবে গাড়ি।

পদ্মা সেতুর প্রথম স্প্যান বসানোর স্মরণীয় মুহূর্তে উপস্থিত ছিলেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, মুন্সীগঞ্জ-২ আসনের এমপি সাগুফতা ইয়াসমিন এমিলি, সেতু বিভাগের সিনিয়র সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম, প্রকল্প পরিচালক শফিকুল ইসলামসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

স্প্যান বসানোর পরে সেতুর জাজিরা জেটিতে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী কথা বলেন গণমাধ্যমের সঙ্গে। তিনি বলেন, প্রথম স্প্যান বাসানোর মধ্য দিয়ে কালো মেঘ কেটে দৃশ্যমান হয়েছে পদ্মা সেতু। সব বাধা উপেক্ষা করে সেতুর কাজ এগিয়ে চলছে। যথাসময়েই সেতুর কাজ শেষ করার চেষ্টা চলছে।

মন্ত্রী বলেন, পর্যায়ক্রমে অন্য স্প্যানগুলো উঠবে। এখন পর্যন্ত এ সেতুর সাড়ে ৪৭ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে।

৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে এই সেতুর মূল কাজ দ্রুতগতিতে চলমান। প্রধানমন্ত্রীর দেশে ফেরার পর উদ্বোধন করা হবে স্প্যান বসানোর কাজ। প্রথম স্প্যানটি এখনো ৩৬০০ টন ক্ষমতার একটি ক্রেনের সঙ্গে বাঁধা রয়েছে। নাট-বোল্ট দিয়ে আটকানোর কাজ শেষ হওয়ার পর ক্রেনটি সরানো হবে। চীন থেকে এটি আনার পর প্রায় ছয় কিলোমিটার দূরে মাওয়ার কুমারভোগ কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডের ওয়ার্কশপে রাখা হয়েছিল। সেখান থেকে রবিবার এটি নিয়ে রওনা হয় একটি ক্রেন। রাতে ২৩ নম্বর পিলারের কাছে যাত্রাবিরতি করে। সোমবার সকালে আবার রওনা হয়ে দুপুরে ৩০ ও ৩১ নম্বর পিলারের মাঝামাঝি নোঙর করে। শুক্রবার দুপুর ২টায় নেওয়া হয় ৩৭ ও ৩৮ নম্বর পিলারের মাঝামাঝি। সন্ধ্যার আগেই দুই পিলারের মাঝামাঝি ঝুলিয়ে রাখা হয়। আর শনিবার সকাল ৮টায় আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণÑ শুরু হয় স্প্যান বসানোর কাজ।

পদ্মা সেতুর প্রতিটি খুঁটির নিচে ছয়টি করে পাইল বসানো হচ্ছে। সব মিলিয়ে পাইলের সংখ্যা ২৪০। ইস্পাতের এসব পাইল মাটির নিচে ৯৬ থেকে ১২৮ মিটার পর্যন্ত গভীরে বসানো হচ্ছে। এ পর্যন্ত ৬৮টি পাইলিংয়ের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। আরও ১৭টি পাইল বসানোর কাজ চলমান। সেতুতে মোট পিলার হবে ৪২টি। এক পিলার থেকে আরেকটির দূরত্ব ১৫০ মিটার। এ দূরত্বের লম্বা ইস্পাতের কাঠামো বা স্প্যান জোড়া দিয়েই সেতু নির্মিত হবে। বর্তমানে ১৬টি খুঁটি বা পিলার নির্মাণের কাজ চলমান। দুটি হ্যামার দিয়ে জাজিরা ও মাওয়া উভয় প্রান্তে পাইলিং করা হচ্ছে। নভেম্বরের শেষ দিকে আরেকটি হ্যামার জার্মানি থেকে আসবে। ইংরেজি অক্ষরের অনেকটা ‘ওয়াই’ আকৃতির আদলে নির্মাণ করা হচ্ছে পদ্মা সেতুর পিলার।

সূত্রমতে, ২০০১ সালের ৪ জুলাই পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। এ সময়ের মধ্যে নানা ষড়যন্ত্রসহ বিলম্ব প্রক্রিয়া চলতে থাকে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসার পর ফেব্রুয়ারি মাসে পদ্মা সেতুর নকশার জন্য পরামর্শক নিয়োগ করা হয়। প্রকল্পে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার ঋণ সহায়তার প্রস্তাব নিয়ে আসে বিশ্বব্যাংক। এরই অংশ হিসেবে সেতুর পরামর্শক নিয়োগে ২০১১ সালে দুর্নীতির অভিযোগ তোলে বিশ্বব্যাংক। সে সময় কারিগরিভাবে সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়া কানাডার এসএনসি লাভালিনের কাছে ঘুষ চাওয়ার অভিযোগে প্রকল্পটির অর্থায়ন স্থগিত করে সংস্থাটি। বিশ্বব্যাংকের দেখাদেখি অন্য দাতাসংস্থাগুলো এক-এক করে মুখ ফিরিয়ে নেয়। অথচ প্রকল্পের সমীক্ষা হয়েছিল জাইকার অর্থে। নকশা প্রণয়ন করা হয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের অর্থায়নে। মূল প্রকল্প বাস্তবায়নে বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, জাইকা ও ইসলামিক উন্নয়ন ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল। প্রকল্প থেকে দাতা সংস্থাগুলো সরে যাওয়ার পর এসএনসি লাভালিনকে কালো তালিকাভুক্ত করে বিশ্বব্যাংক। কানাডার আদালতে এ সংক্রান্ত মামলাও হয়। বাংলাদেশে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) পদ্মা সেতুর দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের মামলা করে। ওই ঘটনায় সেতু বিভাগের সাবেক সচিবসহ প্রকল্পের তৎকালীন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলাও করা হয়। এতে জেলে যেতে হয় তাদের। ওই ঘটনায় মন্ত্রিত্ব হারান তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন। অভিযুক্ত হন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান। পরে অভিযুক্ত সবাইকে দায়মুক্তি দেয় দুদক। ঘটনার এখানেই শেষ নয়Ñ পদ্মা প্রকল্পে দুর্র্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ গালগল্প ছাড়া কিছুই নয় বলে পরে রায় দেন কানাডার আদালত। কিন্তু এসব করতে করতে ২০০১-এর ভিত্তিপ্রস্তরের সময় থেকে পার হয়ে যায় ১৪টি বসন্ত। ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বরে ১১টা ১৬ মিনিটে মুহুর্মুহু করতালির আওয়াজের সঙ্গে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী হাইড্রলিক হ্যামারে নদীর তলদেশে গভীর থেকে গভীরে প্রোথিত হতে থাকে পদ্মা সেতুর মূল পাইল। এর পর আর পেছন ফেরা নেই। গতকাল স্প্যান বসানোর মাধ্যমে সব শঙ্কা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়া হয়।

৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হবে ২০১৮ সালের মধ্যেই। এই সেতু হলে ঢাকার সঙ্গে সরাসরি সড়কপথে যুক্ত হবে দক্ষিণাঞ্চল। চলবে ট্রেনও। এশিয়ান হাইওয়ের পথ হিসেবেও সেতুটি ব্যবহৃত হবে। অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, পদ্মা সেতু চালু হলে দেশের আর্থিক প্রবৃদ্ধিও বাড়বে।

জানা গেছে, ২০০৭ সালে প্রথম অনুমোদনের সময় পদ্মা সেতু প্রকল্পে মোট ব্যয় ধরা হয়েছিল ১০ হাজার ১৬১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। এর পর ২০১১ সালে দাঁড়ায় ২০ হাজার ৫০৭ কোটি ২০ লাখ টাকা। আর সর্বশেষ ব্যয় ধরা হয়েছে ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। এখন পর্যন্ত প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে। আরও ১৪০০ কোটি টাকা ব্যয় বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে প্রকল্পের মোট ব্যয় দাঁড়াচ্ছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। তবে দাতা সংস্থাগুলোর হয়রানি ও ঋণচুক্তি স্থগিত প্রক্রিয়ায় পার হয়ে যায় অনেকগুলো বছর। বিলম্বজনিত কারণে বাড়ছে খরচের পরিমাণও। এখন পর্যন্ত কাজে অগ্রগতি ৪৭ শতাংশ।

২০১৪ সালের ১৮ জুন মূল সেতু নির্মাণে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি সই করে সরকার। তাতে খরচ ধরা হয় ১২ হাজার ১৩৩ কোটি টাকা। আর নদীশাসনের কাজ করছে চীনেরই আরেক প্রতিষ্ঠান সিনোহাইড্রো করপোরেশন। তাদের সঙ্গে চুক্তি হয় ২০১৪ সালের নভেম্বরে। এ কাজের খরচ ধরা হয় ৮ হাজার ৭০৮ কোটি টাকা। দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে এই পদ্মা সেতু।
সূত্র: আমাদের সময় অন লাইন

https://www.bkash.com/